Blog

ভারত ও বাংলাদেশে অটিজম আক্রান্তের সংখ্যা ও ২০২2 এ বিশ্বে অটিজমের গড় চিত্র।

dishadigitalschool

অটিজম কি?

অটিজম হল একটি নিউরোলজিকাল বা স্নায়বিক সমস্যা যাতে আমাদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
এর ফলে, ব্যক্তি কথা বলতে বা বুঝতে, নতুন বিষয় শিখতে এবং সমাজে মেলামেশা করতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন।
অটিজমকে আমরা সাধারণত একটি স্পেকট্রাম ডিস্‌অর্ডার বলে থাকি কারণ এর উপসর্গ নানারকম হতে পারে এবং ক্ষেত্র-বিশেষে একসাথে হতে পারে।
একইসঙ্গে অটিজমের প্রভাব ব্যক্তি-বিশেষে আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। কোনও শিশু হয়ত সামান্য সাহায্য পেলেই স্বাধীন ভাবে সব কিছু করতে পারে, আবার কেউ হয়তো সম্পূর্ণ রূপে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়।

অটিজমের কারণঃ

অটিজম মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বায়োলজি ও কেমিস্ট্রির ফলে সৃষ্ট একটি সমস্যা। এখন পর্যন্ত এই সমস্যার কোন সরাসরি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সারা পৃথিবীতেই এই সমস্যার কারণ জানার জন্য গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।

তবে, মোটামুটি ভাবে কিছু বিষয়ের সমন্বয়ে অটিজম হয়ে থাকে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করে থাকেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জেনেটিক ফ্যাক্টর।

এছাড়া, আরো কিছু বিষয়কে সন্দেহ করা হয় অটিজমের জন্য।

এগুলি হল গর্ভাবস্থায় খাদ্যাভ্যাস, বাচ্চার অন্ত্রের পরিবর্তনগত সমস্যা, মার্কারির(পারদ) বিষক্রিয়া, বাচ্চার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ পরিপাক করতে না পারা, টিকার প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।

তবে কোনো কিছুই এখনো প্রমাণিত নয়।

অবশ্যই পড়ুন-

২০২২ এ অটিজমের গড় চিত্রঃ

এবার আসা যাক বর্তমান বিশ্বে ও ভারতে অটিজমের পরিসংখ্যান বিষয়ে।  

সারা বিশ্বে অটিজমের বর্তমান চিত্র আপনাদের কি জানা আছে?

না জানা থাকলে আমার এই লেখাটি পড়ার পর তা জানতে পারবেন।

বিগত কয়েক বছর ধরে অটিজম আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যেমন- ২০১৬ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৫৪ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশুর অটিজম ধরা পরেছে। এদের প্রত্যেকের বয়স আট বছরের মধ্যে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ তে তা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সারা বিশ্বের অটিজমের সঠিক তথ্য জোগাড় করা ও তা ট্র্যাক করা একটি কঠিন কাজ।

কারণ, বেশিরভাগ দেশই অটিজমের কোনো তথ্য সংগ্রহ করে না ও ট্র্যাক করার কোনো ব্যবস্থাও নেই।

অনেক দেশে কোনো Assessment করার ব্যবস্থাও নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বের যে কোনো মানুষের যে তথ্য সরবরাহ করে সেখান থেকেই অটিজমের সারা বিশ্বের গড় একটা পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে।

উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম অটিজমের হার ইউরোপের দেশগুলোতে।

ফ্রান্সে সবচেয়ে কম অটিজমের হার। এখানে প্রতি ১০,০০০ মানুষের মধ্যে অটিজমের হার ৬৯.৩। অর্থাৎ প্রতি ১৪৪ জনের মধ্যে একজনের লক্ষ্য করা যায়।

পর্তুগালে অটিজমের হার প্রতি ১০,০০০ এ ৭০.৫। অর্থাৎ প্রতি প্রতি ১৪৪ জনে প্রায় ১ জন।

আয়ারল্যান্ড– ৭১.৯ প্রতি ১০,০০০/ ১৩৯ জনের মধ্যে একজন।

নরওয়ে – ৭২.০ প্রতি ১০,০০০/ ১৩৯ জনের মধ্যে প্রায় একজন।

ইতালি -৭২.০ প্রতি ১০,০০০/ ১৩৯ জনের মধ্যে প্রায় একজন।

জারমানি -৭২.০ প্রতি ১০,০০০/ ১৩৯ জনের মধ্যে প্রায় একজন।

গ্রিস- ৭২.৪ প্রতি ১০,০০০/ ১৩৮ জনের মধ্যে প্রায় একজন।

অস্ট্রিয়া– ৭২.৬ প্রতি ১০,০০০/ ১৩৮ জনের মধ্যে প্রায় একজন।

বেলজিয়াম– ৭৩.০ প্রতি ১০, ০০০/ ১৩৭ জনের মধ্যে প্রায় একজন।

স্পেইন– ৭৩.০ প্রতি ১০,০০০/ ১৩৭ জনের মধ্যে প্রায় একজন।

একশ শতাংশের উপর অটিজমের হার এমন ৫টি দেশ হলঃ

  •  কাতার– ১৫১.২ প্রতি ১০,০০০/  ৬৬ জনের মধ্যে জন।
  •  সংযুক্ত আরব– ১১২.৪ প্রতি ১০,০০০/ ৮৯ জনের মধ্যে একজন।
  •  ওমান– ১০৭.২ প্রতি ১০,০০০/ ৯৩ জনের মধ্যে একজন।
  • বাহারিন– ১০৩.৩ প্রতি ১০,০০০/ ৯৭ জনের মধ্যে একজন।
  • সৌদি আরব– ১০০.৭ প্রতি ১০,০০০/ ৯৯ জনের মধ্যে একজন।
বর্তমানে অটিজমের হারের দিকে থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।

এখানে অটিজমের হার ১১২.৪০ প্রতি ১০,০০০ এ। ৮৯ জনের মধ্যে একজন আক্রান্ত।

এবার দেখা যাক ভারতের ও ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির অবস্থা।

ভারতের চিত্রঃ

ভারতে অটিজমের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সরকারিভাবে অটিজমের তথ্য সংগ্রহ করা ও তা ট্র্যাক করার ব্যবস্থা এখানে এখনও সেভাবে শুরু হয়নি।

ভারতে মানুষের অটিজম বিষয়ে অজ্ঞানতা, সচেতনতার অভাব অটিজম নির্ণয়ের মূল সমস্যা। এখানে অভিভাবকরা শিশুর সমস্যা বুঝতে ও চিকিৎসকের কাছে শিশুকে নিয়ে যেতে অনেক দেরি করে ফেলেন।

একটি গবেষণা অনুযায়ী মার্কিন অভিভাকদের চেয়ে ভারতীয়দের অন্তত ৭ মাস বেশি সময় লেগে যায় অটিজমের লক্ষণ নির্ণয় করতে।

তার কয়েকটি কারণ হল-

এখানে অনেকেই এই ধরনের সমাজ বিমুখ মুখচোরা ও লাজুক আচরণকে স্বাভাবিক মনে করেন।

সঠিক চিকিৎসার পরিবর্তে অনেক দম্পতি দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে থাকেন। তারা ভাবেন দ্বিতীয় সন্তান নিলে সে তার ভাই বোনকে ভবিষ্যতে দেখাশুনা করবে।

শিক্ষিত- অশিক্ষিত প্রায় সকলেই অটিজমকে এক ধরনের মানসিক রোগ হিসাবে লঘু করে দেখেন।

আর যারা সচেতন তারা অনেকেই অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ভিটামিন থেরাপি, জ্যোতিষ বিদ্যা সবকিছুই প্রয়োগ করে থাকেন।

No photo description available.

আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ বাচ্চার তিন বছর পর্যন্ত কথা বলতে না পারাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন ও কোনো আমল দিতে চান না।

এই প্রসঙ্গে, আমার সম্পাদিত “অটিজমের অ, আ, ক, খ“- বইটিতে অটিজমের গবেষক অলকানন্দা রুদ্র ম্যামের লেখার কিছু অংশ তুলে ধরলাম-

 

তিনি লিখেছেন- ১৯৮০ সালে ভারতবর্ষে দার্জিলিং এ প্রথম অটিজম নির্ণয় করেন এ.রোনাল্ড নামে ভিয়েনার এক শিশু বিশেষজ্ঞ।

ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত কিছু গবেষণা থেকে আন্দাজ করা যায় ভারতে অটিজম আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি।

১৯৬৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যার গণনা বিভিন্ন সমীক্ষার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল বিভিন্ন হাসপাতালের ভর্তির তালিকা অনুসন্ধান।

এই পর্যবেক্ষণগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলির নিজস্ব পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে, আবার অনেক সময় অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।

অতএব, অনেক অটিজমের কেস এইসব সমীক্ষায় অধরাই থেকে যায়।

ভারতে অটিজমের গবেষণা

তিনি বলেছেন পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতের অটিজম গবেষণা অনেকটাই পিছিয়ে। ১৯৬৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১৫টির বেশি দেশ এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে।

তাদের মধ্যে ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, কানাডা, জার্মানি , সুইডেন, ফ্রান্স, ইরান, চিন ও আইসল্যান্ড উল্লেখযোগ্য।

পূর্ব আলোচনা থেকে আমরা বুঝতেই পারছি যে চোস্ত ইংরেজি না জানা, বহু ভাষী, দেরিতে কথা বলার ক্ষেত্রে সংস্কৃতিগত ভুল ধারণা, জড়তা, গ্রামাঞ্চলে সঠিক চিকিৎসার অভাব, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যয়বহুল চিকিৎসার সুযোগ না নিতে পারা – এইসব কারণগুলির জন্য আমাদের দেশের অটিজমের চিত্রটা এখনও স্পষ্ট নয়।

এখানে অলকানন্দ ম্যামের কথাগুলির সাথে আমি আরেকটা বিষয় উল্লেখ করবো আমাদের দেশের সরকারের উদাসীনতা।

আমাদের দেশের কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকার উভয়ই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের প্রতি উদাসীন। তারা নিয়ম করেছে অনেক কিছুই কিন্তু বাস্তবে কোনও কিছুই প্রতিফলিত হয় না।

অটিজমকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অনেকদিন হল কিন্তু হাতে গোনা দু একটি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র পাওয়া যায় না।

অতএব ১০ বছর আগে অটিজমের যে চিত্র ছিল বর্তমানে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।

উপরে ভারতের অটিজম চিত্র তুলে ধরলাম এবার আসি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ এর অটিজমের হারের বিষয়ে।

ভারতে প্রতি ১০,০০০ মানুষের মধ্যে অটিজমের হার ৮৮.৫০.। অর্থাৎ প্রায় ১১৩ জনের মধ্যে একজন অটিজম আক্রান্ত।

ভারতের বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের অটিজমের হার নিম্নরূপঃ

চিন– ৭৯.৭ প্রতি ১০,০০০/ ১২৫ জনের মধ্যে একজন।

পাকিস্তান– ৮৬.৭ প্রতি ১০,০০০/ ১১৫ জনের মধ্যে একজন।

নেপাল– ৮৩.৩ প্রতি ১০,০০০/ ১২০ জনের মধ্যে একজন।

অটিজম ও বাংলাদেশঃ 

আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও অটিজমের হার বৃদ্ধিতে পিছিয়ে নেই। তবে এখানে জাতীয় সরকার অটিজম সচেতনতায় নানা কর্মসূচী গ্রহণ করায় সনাক্তকরণের হার বাড়ছে।

জানা যায় যে, ২০১১ সালে বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। তারপর থেকেই বাংলাদেশে অটিজম শিশু ও ব্যক্তিদের জন্য নানা উন্নয়নমূলক কর্মসূচী লক্ষ্য করা যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে অটিজমের হার-

৮৫.৩ প্রতি ১০,০০০/ ১১৭ জনের মধ্যে একজন।

উক্ত তালিকা থেকে সহজেই অনুমেয় যে আমাদের দেশ ও আমাদের প্রতিবেশী দেশেও অটিজমের হার উদ্বেগজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিশেষে বলি- অটিজম শিশুরা কোনও ভিনগ্রহের মানুষ নয় তারাও আমাদের মতই সাধারন মানুষ। শুধু আমরা যেভাবে সবকিছু বুঝি ও করি তারা একটু অন্যভাবে বোঝে বা করে। তাদের এই অন্যভাবে বোঝাটাই আমাদের বুঝতে হবে।

Reference: https://worldpopulationreview.com/country-rankings/autism-rates-by-country

ধন্যবাদ।

অবশ্যই পড়ুন-

Sandip Goon

Principal

Disha Digital School

Leave a Reply